অর্থনীতির যে শাখায় সরকারের আয়, ব্যয় ও বর্ণসংক্রান্ত বিষয়াবলি আলোচনা হয়, তাকে সরকারি অর্থব্যবস্থা বলে। একটি দেশের জনসাধারণের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সরকার কোন কোন খাতে, কীভাবে, কোন নীতিতে যার করবে, তা সরকারি অর্থব্যবস্থার আলোচনা করা হয়। সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য কীভাবে, কোন কোন উৎস হতে আয় করবে অথবা কোন টকা থেকে কতটুকু ঋণ গ্রহণ করবে, তা সরকারি অর্থব্যবস্থার আলোচনা করা হয়।
১০.২ বাংলাদেশ সরকারের আরের উৎসসমূহ
বাংলাদেশ একটি নিম্নমধ্যম আরের দেশ। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অকল্যাণ সাধন, প্রশাসন পরিচালনা, দেশ রক্ষা ইত্যাদি কাজে সরকার অনেক অর্থ ব্যয় করে। এই ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে বিভিন্ন উৎস হতে যার সংগ্রহ করতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের আয়ের উৎস প্রধানত দুটি। যথা- ক) কর রাজা খ) করবহির্ভূত রাজ
ক) কর রাজস্ব (Tax Revenue) সরকার জনগণের নিকট হতে বাধ্যতামূলকভাবে যে অৰ্থ আদায় করে কিন্তু ान বमরে म সরকার থেকে সরাসরি বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা আশা করতে পারে না, তাকে কর বলে। সরকার দেশের নিবাসী বা অনিবাসী ব্যক্তি, বিভিন্ন ব্যবসায় ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং পণ্যের উপর যে কর ধার্য করে, তা থেকে প্রাপ্ত আরকে কর রাজস্ব বলা হয় ।
সরকারের কর রাজস্বের উৎসসমূহ হলো-
১. আর ও মুনাফার উপর কর (Taxes on Income and Profit)
কোনো ব্যক্তির না কোম্পানির পালের উপর যে কর ধার্য করা হয়, তাকে আয়কর বলে। বাংলাদেশ সরকারের আারের একটি অন্যতম উৎস হলো আয়কর। বর্তমানে বাংলাদেশে কোম্পানি ি করদাতা যাদের বার্ষিক নীট আর ২,৫০,০০০ টাকা (পুরুষদের ক্ষেত্রে)। ৩,০০,০০০ টাকা (মহিলাদের এবং ৬৫ বছর বা অঘোর্য বছরের পুরুষের ক্ষেতে): ৩,৭৫,০০০ টাকা (প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে) এবং ৪,২৫,০০০ টাকা এর অধিক (মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে) তাদের আয়ের উপর এ কর ধার্য করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির মুনাফার উপর কর ধার্য করা হয়।
২. মুল্য সংযোজন কর (Value Added Tax)
অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে ১৯৯১-৯২ অর্থবছর থেকে মূল্য সংযোজন কর চালু করা হয়েছে। উৎপাদন ক্ষেত্রে কাঁচামাল থেকে করে চূড়ায় দ্রব্য উৎপাদন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ক্রম করতে হয়। উৎপাদনের এরূপ বিভিন্ন স্তরে যে মূল্য সংযোজিত হয় তার উপর একটি নির্দি যারে যে কর আরোপ করা হয়, তাকে মূল্য সংযোজন কর (Value Added Tax VAT) বলে,বর্তমানে আমাদের দেশে আমদানিকৃত দ্রব্য ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত দ্রব্য এবং বিভিন্ন সেবা খাতের উপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে । ভবিষ্যতে এ খাতের আওতা আরও সম্প্রসারিত করা হবে ।
৩. আমদানি শুল্ক (Custom Duties)
বাংলাদেশে সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস হলো আমদানি শুল্ক । দেশের আমদানিকৃত দ্রব্যের ও সেবার উপর যে কর ধার্য করা হয়, তাকে আমদানি শুল্ক বলে ।
৪. আবগারি শুল্ক (Excise Duties)
দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত ও ব্যবহৃত দ্রব্যের উপর যে কর ধার্য করা হয়, তাকে আবগারি শুল্ক বলা হয়। রাজস্ব সংগ্রহ ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষতিকর দ্রব্যের ভোগ হ্রাস করার উদ্দেশ্যেও আবগারি শুল্ক ধার্য করা হয় । বাংলাদেশে প্রধানত চা, সিগারেট, চিনি, তামাক, কেরোসিন, ওষুধ, স্পিরিট, দিয়াশলাই প্রভৃতি দ্রব্যের উপর আবগারি শুল্ক ধার্য করা হয় ।
৫. সম্পূরক শুল্ক (Supplementary Duties) বিভিন্ন কারণে সরকার অনেক দ্রব্যসামগ্রীর উপর আবগারি শুল্ক বা মূল্য সংযোজন কর বা আমদানি শুল্ক আরোপের পরেও অতিরিক্ত যে শুল্ক আরোপ করে, তাকে সম্পূরক শুল্ক বলে। যেমন, সিরামিক টাইলসের উপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক ।
৬. অন্যান্য কর ও শুল্ক ( Other Taxes and Duties)
উপরের শুল্ক ও করের মূল পাঁচটি উৎস ছাড়াও আরও কিছু কর ও শুল্ক থেকে সরকার আয় সংগ্রহ করে । যেমন : সম্পত্তি কর, পেট্রোল ও গ্যাসের উপর কর, বিদেশ ভ্রমণ কর, প্রমোদ কর ইত্যাদি।
৭. মাদক শুল্ক (Narcotics and Liquor Duty )
মাদকজাতীয় বিভিন্ন দ্রব্যের উপর সরকার শুল্ক বসিয়ে অর্থ আয় করে থাকে। এর মাধ্যমে সরকারের আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধি পায় ৷
৮. যানবাহন কর (Tax on Vehicles)
বিভিন্ন প্রকার যানবাহনের উপর যে কর দেওয়া হয়, তাকে যানবাহন কর বলে। এ খাত থেকে সরকার প্রতিবছর অনেক অর্থ আয় করে থাকে ।
৯. ভূমি উন্নয়ন কর (Land Development Tax)
ভূমির মালিকানা ও ভোগদখলের জন্য ভূমির মালিক সরকারকে যে খাজনা দেয়, তাকে ভূমি রাজস্ব বলে । বাংলাদেশ সরকার ভূমির উপর উন্নয়ন কর আরোপ করেছে ।
১০. নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প (Non-Judicial Stamp )
দলিলপত্র ও মামলা-মোকদ্দমার আবেদনপত্র ব্যবহারের জন্য নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হয় । এ খাত হতে সরকার প্রতিবছর অনেক অর্থ আয় করে ।
খ) করবহির্ভূত রাজস্ব (Non-Tax Revenue)
সরকার কর ও শুল্ক ছাড়া আরও অনেক উৎস হতে রাজস্ব সংগ্রহ করে । এই উৎসগুলো থেকে অর্জিত রাজস্বকে করবহির্ভূত রাজস্ব বলে ।
সরকারের করবহির্ভূত রাজস্বের উৎসসমূহ হলো-
১. লভ্যাংশ ও মুনাফা (Dividend and Profit) সরকার তার মালিকানাধীন বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেমন- ব্যাংক, বিমা কোম্পানি এবং অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান (যেমন- রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান, পার্ক, চিড়িয়াখানা) থেকে বছরান্তে লভ্যাংশ ও মুনাফা পেয়ে থাকে ।
২. সুদ (Interest) সরকার, সরকারি কর্মচারী, বিভিন্ন আর্থিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করে । প্রদত্ত ঋণের সুদ হিসেবে সরকার প্রতিবছর কিছু অর্থ আয় করে থাকে ।
৩. প্রশাসনিক ফিস (Administrative Fees )
সরকার জনগণকে প্রশাসনিক সেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন প্রকার ফি আদায় করে থাকে । যেমন- কোর্ট ফিস ।
৪. জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ (Fine, Penalty and Confiscation) দেশের আইন ও নিয়মনীতি পরিপন্থী বিভিন্ন কাজের জন্য সরকার জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ করে প্রতিবছর কিছু অর্থ আয় করে থাকে ।
৫. অর্থনৈতিক সেবা (Economic Services) সরকার তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্বারা জনগণকে সেবা প্রদান করে থাকে। এ সেবাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আমদানি-রপ্তানি আইনের আওতায় প্রাপ্ত ফিস, বাণিজ্য সংস্থা ও কোম্পানিসমূহ হতে প্রাপ্ত রেজিস্ট্রেশন ফিস, বিমা আইনের আওতায় প্রাপ্তি ও সমবায় সমিতিসমূহের অডিট ফিস, সমবায় সমিতি রেজিস্ট্রেশন ও নবায়ন ফিস ইত্যাদি ।
৬. ভাড়া ও ইজারা (Rent and Lease)
সরকারি বিভিন্ন সম্পত্তি ভাড়া ও ইজারা দেওয়ার মাধ্যমে সরকার প্রতিবছর অনেক অর্থ আয় করে থাকে । যেমন : হাট, ঘাট।
৭. টোল ও লেভি (Toll and Levy)
বিভিন্ন সেতু থেকে টোল ও লেভি আদায় বাবদ সরকার কিছু অর্থ আয় করে থাকে । যেমন : সেতুর জন্য টোল আদায়।
৮. অ-বাণিজ্যিক বিক্রয় (Non Commercial Sales)
সরকার জনগণের কল্যাণে কোনো কোনো সময় বিনা লাভে অনেক দ্রব্য বিক্রয় করে থাকে । যেমন : ও.এম.এস বা খোলা বাজার বিক্রয় নীতি ।
১) রেলওয়ে ( Railway)
বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রীবহন ও দ্রব্যসামগ্রী পরিবহনের ভাড়া বাবদ আয় করে। রেলওরে সেবাকে সম্প্রসারণ, আধুনিকায়নের ফলে বর্তমানে এ খাতে মুনাফার পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
১০) ডাক বিভাগ (Postal Department)
বাংলাদেশের ডাক বিভাগ সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয় বিধায় এটি সরকারের আয়ের একটি উৎস। ডাক
বিভাগ বহুমুখী সেবা প্রদান করার ফলে ২০০১-০২ সাল হতে এ খাতে আয় প্রবাহ কিছুটা বৃদ্ধি পায় ।
উপরে উল্লিখিত বাংলাদেশ সরকারের আয়ের উৎসসমূহ থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাণ যথেষ্ট নয় । তাই প্রতিবছর সরকারকে ব্যয় নির্বাহের জন্য বিদেশি ঋণ, সাহায্য, দান, অনুদান এসবের উপর নির্ভর করতে হয়।
Read more